রাজা হরিশ্চন্দ্রের নাম সত্য কথা বলার জন্য, সারা পৃথিবী বিখ্যাত ছিল। এনার জন্ম ইক্ষ্বাকু বংশের ত্রিশঙ্কু নামক এক রাজার কাছে হয়েছিল, এবং তার মায়ের নাম তথা রাজা ত্রিশঙ্কু্র পত্নীর নাম ছিল সত্যবতী।
রাজা হরিশ্চন্দ্র সত্য কথা বলা এবং নিজের বচন পালন করার জন্য বিখ্যাত ছিলেন। এবং তিনি অনেক বড়ো দানী ছিলেন। ওনার বিষয়ে একটি কথা খুব প্রসিদ্ধ ছিল :
“चन्द्र टरे सूरज टरे, टरे जगत व्यवाहर।
पै दृढ़ हरिश्चन्द्र को, टरे न सत्य विचार।।
অর্থাৎ, চাঁদ এবং সূর্য নিজের স্থান পরিবর্তন করতে পারে, কিন্তু রাজা হরিশ্চন্দ্র কখনোই নিজের সত্য বচন পালন করতে পিছপা হন না।
রাজা হরিশ্চন্দ্রের স্ত্রীর নাম তারামতী এবং পুত্রের নাম রোহিতাশ্ব। এবং রাজা হরিশ্চন্দ্র ঝষি বশিষ্টের শিশ্য ছিলেন।
একবার ঝষি বিশ্বামিত্র রাজা হরিশ্চন্দ্রের অনেক প্রষিদ্ধি শুনেছিলেন। কিন্তু তিনি তা কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেন না, তাই তিনি সয়ং রাজা হরিশ্চন্দ্রের পরীক্ষা নিতে চাইলেন। ঝষি বশিষ্ট মুনি তাঁর শিষ্যের উপরে বিশ্বাস করতেন। তাই তিনি ঝষি বিশ্বামিত্রকে বললেন যে তিনি আনন্দ সহকারে তাঁর শিষ্য রাজা হরিশ্চন্দ্রের পরীক্ষা নিতে। এবং এও বললেন যে তিনি ঝষি বিশ্বামিত্র এবং রাজা হরিশ্চন্দ্রের মাঝে মধ্যস্থ হবেন না।
শুধু ঝষি বশিষ্ট একটি শর্ত রাখলেন, যদি রাজা হরিশ্চন্দ্র এই পরীক্ষায় পাশ করেন, তাহলে ঝষি বিশ্বামিত্রকে তাঁর তপস্যার ফল রাজা হরিশ্চন্দ্রকে দিতে হবে। এই আলোচনা দেবরাজ ইন্দ্রের সভায় হচ্ছিল, এবং সেখানে মহামুনি নারদ উপস্থিত ছিলেন। অবশেষে ঠিক করা হলো যে রাজা হরিশ্চন্দ্রের পরীক্ষা নেওয়া হবে।
ঝষি বিশ্বামিত্রের মায়া পরীক্ষা :
একদিন রাজা হরিশ্চন্দ্র রাতের বেলায় স্বপ্ন দেখলেন যে একজন সুন্দরী স্ত্রী তাঁর দরবারে এসে নৃত্য এবং গায়ন করলেন। রাজা হরিশ্চন্দ্র তার নৃত্য এবং সংগীত প্রদর্শনে বেশ আনন্দিত হলেন এবং তাকে উপহার হিসেবে কিছু চাইতে বললেন। ওই সুন্দরী স্ত্রী রাজাকে বললেন যে তিনি রাজার পত্নী হতে চান। রাজা হরিশ্চন্দ্র অনুরোধ করে বললেন যে তিনি বিবাহিত এবং এবং তিনি অন্য মহিলাকে তাঁর স্ত্রী বানাতে পারবেন না। এবং রাজা এও অনুরোধ করলেন যে তিনি অন্য কিছু চেয়ে নিক। তখন সেই সুন্দরী স্ত্রী বললেন, তাহলে এই রাজ্য তাকে দান করে দিতে। রাজা হরিশ্চন্দ্র অত্যন্ত বিনম্র হয়ে বললেন, “দান সুপাত্র কে দিতে হয়, কুপাত্র কে নয়”। হঠাৎই এই সময়ে ঝষি বিশ্বামিত্র চলে আসেন। এসেই তিনি রাগাণ্বিত হয়ে বলেন যে, “আপনি দান দেওয়ার কথা বলে এই ভাবে মুখ ফেরাতে পারেন না”।
রাজা হরিশ্চন্দ্র অত্যন্ত বিনম্র হয়ে বললেন, “মহাঝৃষি, দান তো সুপাত্রকে দেওয়া হয়…”। ঝষি বিশ্বামিত্র, রাজা হরিশ্চন্দ্রের উদ্দেশ্যে বললেন, “তাহলে এই সমস্ত রাজ্য আমায় এখন দান করুন…”। রাজা হরিশ্চন্দ্র এক মুহুর্ত সময় নষ্ট না করে সমস্ত রাজ্য ঝষি বিশ্বামিত্রকে দান করলেন।
হঠাৎই, রাজা হরিশ্চন্দ্রের ঘুম ভেঙ্গে গেলে, তিনি তাঁর স্ত্রীকে এই সমস্ত কথা বললেন। এবং এও বললেন তাঁর স্ত্রী যেন শীঘ্রই তাঁর সন্তানকে নিয়ে নিজের বাপের বাড়ি চলে যায়। তাঁর স্ত্রী তাকে বোঝানোর চেষ্টা করেন, যে তিনি মাত্র স্বপ্ন দেখেছেন। তখন রাজা হরিশ্চন্দ্র তাঁর স্ত্রীকে বোঝালেন, যে দান তো দানই হয়। স্বপ্নে দান দেওয়া হোক কিংবা বাস্তবে। এবং তিনি এও বললেন যে, এই সংসারও তো স্বপ্নেরই মতোই। শুধু পার্থক্য এই যে ঘুমে চোখ বন্ধ করে স্বপ্ন দেখা হয় এবং দিনে চোখ খুলে…।
রাজা হরিশ্চন্দ্র এই বলে বনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। তাঁর স্ত্রী তাকে অনেক ভালোবাসে এবং নিজের স্বামীর এই মহানতা দেখে তিনিও রাজা হরিশ্চন্দ্রের সঙ্গে বনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এই সময় তাঁর পুত্র রোহিতাশ্ব এসে উপস্থিত হয়, এবং সেও বনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
পরের দিন তাঁরা বনে যাওয়ার জন্য তৈরি হয় এবং তখনই ঝষি বিশ্বামিত্র এসে উপস্থিত হয়, এবং রাজাকে কটাক্ষ করে বলেন, “এতটা মোহ নিজের রাজপাঠ নিয়ে, যে এখনো বনে গেলে না… এবং ঝষি ক্রোধের সাথে বলে, তারাতারি বনে যাও এবং এই বস্ত্র-আভূষণ রেখে যাও, কারন এগুলো আমার সম্পত্তি”। রাজা এবং তাঁর স্ত্রী-পুত্র সমস্ত বস্ত্র আভূষণ রেখে, সাধারণ পোশাক পরে বনে যাওয়ার জন্য তৈরি হলেন। তখন ঝষি বিশ্বামিত্র বললেন, তুমি আমায় দান তো দিলে কিন্তু দক্ষিণা দিলে না। রাজা হরিশ্চন্দ্র তাঁর রাজকোষ অধিকারীকে এক হাজার স্বর্ন মুদ্রা দক্ষিণা দেওয়ার কথা বললেন, কিন্তু ঝষি বিশ্বামিত্র বললেন, এই রাজকোষ আমার, তুমি এখান থেকে আমায় দক্ষিণা দিতে পারো না। তখন রাজা হরিশ্চন্দ্র বললেন, যে তাকে এক মাস সময় দেওয়া হোক, তিনি অবশ্যই ঝষি বিশ্বামিত্রকে দক্ষিণা দেবেন। ঝষি বিশ্বামিত্র বললেন এক মাসের এক হাজার স্বর্ন মুদ্রা দক্ষিণা দিতে হবে, যদি এক দিনও বেশি হলে তুমি মিথ্যেবাদী রাজা হবে।
রাজা হরিশ্চন্দ্র রাজি হলেন এবং স্ত্রী ও পুত্রকে নিয়ে বনে চলে গেলেন। তিনি এক এক করে পরিশ্রম করে স্বর্ন মুদ্রা একত্র করার চেষ্টা করলেন। সময় মতো খাওয়া হয়না, ঘুম হয়না, রাজা এবং তাঁর স্ত্রী-পুত্র স্বর্ন মুদ্রা একত্র করার চেষ্টা করে চলেছেন। ২৯ দিন হয়ে গেছে, রাজা এবং তাঁর স্ত্রী-পুত্র এক হাজার স্বর্ন মুদ্রা একত্র করে নিয়েছে।
তিনি সমস্ত মুদ্রা একত্র করে, একটি পোটলি তে বেধে রাখলে। কিন্তু ওই দিন রাতে চোর এসে সমস্ত স্বর্ন মুদ্রা নিয়ে চলে যায় এবং তার জায়গায় একটি মাটি ও পাথর ভরা পোটলি রেখে চলে যায়। পরের দিন ঝষি বিশ্বামিত্র রাজার বন কুটিরে এসে হাজির হয়, রাজা ওই পোটলি যখন ঝষি বিশ্বামিত্রের হাতে দেন, তখন ঝষি দেখে কেবল মাটি আর পাথর পরে আছে। ঝষি অত্যন্ত ক্রোধিত হয়ে যান এবং রাজা হরিশ্চন্দ্রের উদ্দেশ্যে বলেন, “বাহ রাজা, যদি দক্ষিণা দিয়ে অপমান করার ছিল, তাহলে আগেই বলে দিতে… ”
রাজা হরিশ্চন্দ্র ক্ষমা চেয়ে বললেন, “মহাঝষি আমি এক এক করে স্বর্ন মুদ্রা একত্র করে এই পোটলিতে রেখেছিলাম, কিন্তু জানি না কি হয়ে গেল? আজ সন্ধার মধ্যে আমি যদি আপনাকে দক্ষিনা দিতে না পারি, তাহলে এই জগৎ থেকে আমার নাম মুছে যাবে।” এবং এই বলে তিনি তাঁর স্ত্রী-পুত্র কে নিয়ে কাশী-র বাজারে বেচার জন্য নিয়ে চলে গেলেন। কাশী-র বাজারে নিলাম উঠলো, প্রথমে তাঁর স্ত্রী কে বিক্রি করা হলো পাচঁশো স্বর্ন মুদ্রায়। এর পরে রাজা হরিশ্চন্দ্রের সন্তান বিক্রি হলো দুশো স্বর্ন মুদ্রায়। এর পরেও যখন এক হাজার স্বর্ন মুদ্রা একত্র হয়নি, রাজা সয়ং নিজেকে তিনশো স্বর্ন মুদ্রায় বিক্রি করে দিলেন। এবং এই এক হাজার স্বর্ন মুদ্রা ঝষি বিশ্বামিত্রকে দক্ষিণা দিয়ে নিজের বচন পালন করলেন।
রাজা হরিশ্চন্দ্রের স্ত্রী-পুত্র একজন জমিদারের কাছে চাকরের কাজ করেন। দিন রাত তাদের কাজ করতে হয়, খাবারও সময় মতো পেতো না তারা। কিন্তু তারা কোনো প্রতিবাদ করতে পারতো না কারন তাদের বিক্রি করা হয়েছিল। এবং রাজা হরিশ্চন্দ্র একজন চন্ডালের কাছে কাজ করেন, রাজা হয়েও তাকে ডোমের কাজ করতে হয়। তিনি মালিকের সেবা করতেন, এবং সারাক্ষণ শ্মশানেই থাকতেন ও দেখাশোনা করতেন। শুল্ক ছারা মৃত দেহ জ্বালাতে দিতেন না, এটা তাঁর মালিকের আদেশ ছিল।
একবার রাজা হরিশ্চন্দ্রের পুত্র জমিদারের স্ত্রীর জন্য ফুল তুলতে গেল, এবং তাকে সাপে দংশন করলো। যার ফলে তাঁর পুত্র মারা গেলেন। তাঁর মা অর্থাৎ রাজা হরিশ্চন্দ্রের পত্নী অনেক কান্না করলেন কিন্তু তবুও কিছু হলো না। যখন তিনি তাঁর পুত্রকে শ্মশানে নিয়ে এলেন, তখন রাজা হরিশ্চন্দ্র মৃত দেহ পোড়াতে দিলেন না। কারন তাঁর মালিকের আদেশ শুল্ক ছারা মৃত দেহ পোড়ানো যাবে না। তিনি বুঝতে পারলেন যে তাঁর স্ত্রী এবং তাঁর মৃত পুত্র তাঁর সামনে রয়েছে, তবুও তিনি কিছু করতে পারলেন না। রাজা হরিশ্চন্দ্রের স্ত্রী নিজের শাড়ির এক অংশ ছিড়ে শুল্ক হিসেবে দান করলেন।
এই সময় কাশী-র রাজা তার সৈনিক নিয়ে হাজির হয়, এবং বলেন এই স্ত্রী ছোট বাচ্চাদের হত্যা করে, তাই তাকে মৃত্যু দন্ড দেওয়া হলো। রাজা হরিশ্চন্দ্রের সামনেই তাঁর স্ত্রীর মৃত্যু দন্ড ঘোষণা করা হলো এবং রাজা হরিশ্চন্দ্রকেই আদেশ দেওয়া হলো তাঁর স্ত্রী কে মৃত্যু দন্ড দিতে। রাজা হরিশ্চন্দ্র এটা বিধির বিধান মনে করে, নিজের স্ত্রীকে মৃত্যু দন্ড দিতে লাগলেন।
ওই সময়ই ভগবান নারায়ণ, দেবী লক্ষ্মী, নারদ মুনি এবং ঝষি বিশ্বামিত্র উপস্থিত হলেন। রাজা হরিশ্চন্দ্রের পুত্র রোহিতাশ্ব জীবিত হয়ে গেলেন। ভগবান বিষ্ণু রাজা হরিশ্চন্দ্রের প্রশংসা করলেন এবং তাকে আশির্বাদ করলেন, “হরিশ্চন্দ্র তোমার জয় হোক। তুমি সত্যের জন্য সব কিছু ত্যাগ করলে। ধর্ম এবং কর্তব্য তোমায় সত্যের পথে চলা থেকে আটকাতে পারবেনা।”
ঝষি বিশ্বামিত্র, রাজা হরিশ্চন্দ্রকে আশির্বাদ করলেন এবং বললেন যে এটি তাঁর নেওয়া পরীক্ষা ছিল, “তিনি বললেন, যতদিন সূর্য এবং চন্দ্র আকাশে থাকবে, ততদিন রাজা হরিশ্চন্দ্রের নাম থাকবে। যখনই সত্যের কথা হবে, সবার প্রথমে রাজা হরিশ্চন্দ্রের নাম আসবে”। তিনি রাজা হরিশ্চন্দ্রকে নিজের ষাট হাজার (৬০,০০০) বছরের তপস্যার ফল দিলেন। এবং রাজাকে তাঁর রাজ্য ফিরিয়ে দিলেন। ঝষি বশিষ্ট মুনি খুশি হলেন।