পঞ্জিকা অনুসার প্রতি বছর, কার্তিক মাসে কৃষ্ণপক্ষ ত্রয়োদশীর দিন ধনবন্তরি ত্রয়োদশী পালন করা হয়। কারন এই দিন সমুদ্র মন্থনের মাধ্যমে ভগবান ধন্বতরি প্রকট হয়েছিলেন, এবং এই দিন ওনার বিশেষ পূজো করা হয়। সমুদ্র মন্থনের সময় ভগবান ধন্বতরির সাথে অন্যান্য মূল্যবান জিনিস প্রকট হয়েছিলেন।
সমুদ্র মন্থন কথা : ধর্ম গ্রন্থ অনুসারে, একবার মহর্ষী দুর্বাসা স্বর্গের দেবতাদের অভিশাপ দিয়েছিলেন, এবং স্বর্গ নিঃস্ব হয়ে গিয়েছিল। তখন সকল দেবতারা মিলে, ভগবান বিষ্ণুর কাছে গিয়েছিলেন, এই অভিশাপ থেকে মুক্তির উপায় জানার জন্য। তখন ভগবান বিষ্ণু দেবতাদের উপদেশ দেন, অসুরদের সাথে মিলে সমুদ্র মন্থন করার। এবং এও বলেন, সমুদ্র মন্থনের দ্বারা উৎপন্ন হওয়া অমৃত গ্রহন করলে তাঁরা সকলেই অমর হয়ে যাবেন। এর পর দেবতারা অসুরদের রাজা বলির কাছে গিয়ে বললেন, এবং সকল অসুররাও রাজি হয়ে গেল। এর পরে, বাসুকি নাগের দ্বারা মন্দরাচল পর্বতকে জরিয়ে সমুদ্রে মন্থন করা হলো। এর ফলে ১৪ প্রকার রত্ন সমুদ্র মন্থনের দ্বারা পাওয়া গেছিল এবং সবার শেষে অমৃত পাওয়া যায়।
(এর বাস্তব জীবনে অর্থ হল, নিজের ইন্দ্রিয়ের প্রতি সংজম হওয়া। এবং ১৪ সংখ্যার মানে হলো ৫ টি কর্মেন্দ্রিয়, ৫ টি জ্ঞানেন্দ্রিয়, এবং ৪ টি ইন্দ্রিয় হলো – মন, বুদ্ধি, চিন্তা এবং অহংকার। এই সকল ইন্দ্রিয়তে নিয়ন্ত্রন করলে পরমাত্মা অর্থাৎ অমৃত প্রাপ্ত হয়।)
সমুদ্র মন্থন থেকে প্রাপ্ত রত্ন
১. কালকূট বিষ : সমুদ্র মন্থনে সবার প্রথম এই কালকূট বিষ উৎপন্ন হয়, যা ভগবান শিব গ্রহন করেন। এর অর্থ হলো, অমৃত (পরমাত্মা) আমাদের সকলের মনেই উপস্থিত আছে। আমাদের সেই অমৃত পেতে গেলে সর্বপ্রথম নিজের মনের মন্থন করতে হবে। মনের মন্থন করার সময় খারাপ বিচার বাইরে বেরিয়ে আসে, যা এই কালকূট বিষ। পরমাত্মার কাছে এই খারাপ বিচারকে সমর্পিত করে মুক্ত হয়ে যেতে হয়।
২. কামধেনূ গরূ : সমূদ্র মন্থনে দ্বিতীয় রত্ন ছিল কামধেনূ গরু। ওই গরূ ব্রহ্মবাদী ঋষিরা নিজের কাছে রেখেছিলেন, কারন কামধেনূ গরু যজ্ঞের সামগ্রী উৎপন্ন করতে পারতো। এই কামধেনূ গরু হলো আমাদের মনের নির্মলতার প্রতীক। মনের বিষ বেরিয়ে যাওয়ার পরে মন নির্মল হয়ে যায়।
৩. উচ্চশ্রবা ঘোড়া : সমূদ্র মন্থনে তৃতীয় রত্ন ছিল উচ্চশ্রবা ঘোড়া। যা সাদা রঙের ছিল এবং রাক্ষসদের রাজা বলি তা নিজের কাছে রেখে দেন। এই উচ্চশ্রবা ঘোড়া হলো আমাদের মনের প্রতীক। মনের গতি যা আলোর থেকেও বেশী তাকে নিয়ন্ত্রন করা প্রয়োজন। মনকে নিয়ন্ত্রণ করতে হলে তার প্রতি কঠোর হতে হয়।
৪. ঐরাবত হাতি : সমূদ্র মন্থনের চতুর্থ রত্ন ছিল ঐরাবত হাতি, যা চারটি বড়ো বড়ো দাঁত ছিল। ঐরাবত হাতি কৈলাশ পর্বতের থেকেও বেশি উজ্জ্বল ছিল। যা দেবরাজ ইন্দ্র নিজের কাছে রেখে দেন। ঐরাবত হাতি বূ্দ্ধির প্রতীক এবং তাঁর চার দাঁত লোভ, মোহ, বাসনা এবং ক্রোধের প্রতীক। তাই এই লোভ, মোহ, বাসনা এবং ক্রোধের উপরে নিয়ন্ত্রণ করতে হলে চমৎকার বুদ্ধির প্রয়োজন।
৫. কৌস্তূভ মণি : সমূদ্র মন্থনে পঞ্চম রত্ন ছিল কৌস্তূভ মণি, যা ভগবান বিষ্ণু নিজের হৃদয়ে ধারন করেন। কৌস্তূভ মণি ভক্তির প্রতীক। যখন মন শুদ্ধ হয়, তখন শুধু ভক্তি থাকে, যা ভগবান গ্রহন করেন।
৬. কল্পবৃক্ষ : সমূদ্র মন্থনে ষষ্ঠ রত্ন ছিল কল্পবৃক্ষ, এই বৃক্ষ দেবতারা স্বর্গে স্থাপন করেন। এই কল্পবৃক্ষ হলো ইচ্চার প্রতীক যা সকলের ইচ্ছা পূরণ করে। অমৃত অর্থাৎ পরমাত্মাকে পেতে গেলে ইচ্ছের ত্যাগ করা প্রয়োজন।
৭. রম্ভা অপ্সরা : সমূদ্র মন্থনের সপ্তম রত্ন ছিল রম্ভা অপ্সরা। যিনি অনেক সুন্দরী এবং মোহনীয় ছিলেন। রম্ভা দেবতাদের কাছেই চলে গেলেন। এই অপ্সরা হচ্ছে আমাদের মনের সুপ্ত বাসনার প্রতীক। যখন মন পরমাত্মায় বিলিন হতে চায়, তখন বাসনা আমাদের মনকে বিচলিত করে। তাই মনের নিয়ন্ত্রণের জন্য এই বাসনা ত্যাগ করতে হয়।
৮. দেবী লক্ষ্মী : সমূদ্র মন্থনে অষ্টম রত্ন ছিলেন দেবী লক্ষ্মী। অসুর, দেবতা, ঋষি প্রত্যেকে দেবী লক্ষ্মীকে চেয়েছিলেন, কিন্তু দেবী লক্ষ্মী ভগবান বিষ্ণুকে বরণ করেন। দেবী লক্ষ্মী ধন, বৈভব এবং ঐশ্বর্যের প্রতীক, যা সাংসারিক সুখের জন্য প্রয়োজন। কিন্তু পরমাত্মা লাভের জন্য এই সাংসারিক সুখকেও আমাদের ঈশ্বরের কাছে সমর্পণ করতে হয়।
৯. বারূণী দেবী : সমূদ্র মন্থনে নভম রত্ন ছিল বারূনী দেবী। দেবতাদের অনুমতিতে দৈত্ব্যরা বারূণী দেবীকে নিজেদের কাছে নিয়ে নেন। বারূণী কথার অর্থ হলো মদিরা, অর্থাৎ নেশার দ্রব্য। আর অমৃতের জন্য নেশা পরিত্যাগ করা প্রয়োজন।
১০. চন্দ্রমা অর্থাৎ চাঁদ : সমূদ্র মন্থনে দশম রত্নছিল চন্দ্রমা অর্থাৎ চাঁদ। যা ভগবান শিব নিজের মস্তকে ধারন করে নেন। চন্দ্রমা হলো হলো শীতলতার প্রতীক। যখন আমাদের মন খারাপ বিচার, লোভ, বাসনা, নেশা ইত্যাদি ত্যাগ করে, তখন তা শীতল হয়ে যায়।
১১. পারিজাত বৃক্ষ : সমূদ্র মন্থনে একাদশ পর্যায়ে প্রকট হয় পারিজাত বৃক্ষ। কথিত আছে, এই বৃক্ষকে স্পর্শ করলে রোগ এবং আলস্যভাব দূর হয়। এই পারিজাত বৃক্ষ হলো, সফলতার আগের শান্তির প্রতীক। যখন আমরা পরমাত্মার নিকট আসতে শুরু করি, তখন শারীরিক আলস্য দূর হয়ে যায়, এবং মনে এক প্রকার শান্তি বিরাজ করে।
১২. পঞ্চজয় শঙ্খ : সমূদ্র মন্থনে দ্বাদশ পর্যায়ে প্রকট হয় পঞ্চজয় শঙ্খ। যা ভগবান বিষ্ণু ধারন করেন। শঙ্খ হলো বিজয়ের প্রতীক। যখন আমরা পরমাত্মার থেকে মাত্র এক ধাপ পিছিয়ে থাকি, তখন আমাদের মনে বিজয়ের অনুভূতি হয়। এবং এই স্থিতিতেই পরমাত্মার সাক্ষাৎকার হয়।
১৩ এবং ১৪ অমৃত কলশ হাতে ভগবান ধব্নন্তরি : সমূদ্র মন্থনের শেষ পর্যায়ে ভগবান ধব্নন্তরি অমৃতের কলশ হাতে প্রকট হন। ভগবান ধব্নন্তরি হলেন নিরোগ শরীর এবং নির্মল মনের প্রতীক। যখন আমাদের শরীর নিরোগ এবং মন নির্মল থাকে, তখন আমরা পরমাত্মার দর্শন অর্থাৎ অমৃতের স্বাদ পাই। এই চতুর্দশ তম অর্থাৎ ১৪ তম পর্যায়ে আমাদের অমৃতের স্বাদ পাওয়ার অর্থ হলো – আমাদের ৫ কর্মেন্দ্রিয়, ৫ জননেন্দ্রিয় এবং অন্য চারটি হলো (মন, বুদ্ধি, চিন্তা এবং অহংকার) এই সকলের প্রতি নিয়ন্ত্রন থাকলে আমরা অমৃতের স্বাদ অর্থাৎ পরমাত্মার দর্শন পাই।