হিন্দু পুরাণে ভগবান বিষ্ণুর অপরিসীম শক্তি ও গৌরব

হিন্দু ধর্মের ত্রিমূর্তি—ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বর (শিব) এর মধ্যে ভগবান বিষ্ণু পালনকর্তা হিসেবে পরিচিত। তিনি সৃষ্টির ভারসাম্য রক্ষা করেন, অসুরদের বিনাশ করেন এবং ধর্মের প্রতিষ্ঠা করেন। হিন্দু পুরাণে বিষ্ণুর শক্তি ও প্রভাব এতটাই গভীর যে তিনি যুগে যুগে বিভিন্ন অবতারে আবির্ভূত হয়ে মানবজাতিকে রক্ষা করেছেন। এই নিবন্ধে আমরা হিন্দু ধর্মে বিষ্ণুর শক্তির গভীরতা, তাঁর অবতারগণ, এবং ভক্তদের প্রতি তাঁর কৃপাশীলতা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।


ভগবান বিষ্ণুর পরিচয়

বিষ্ণু সংস্কৃত শব্দ ‘বিশ্লি’ থেকে উদ্ভূত, যার অর্থ ‘সর্বত্র বিরাজমান’। তিনি শ্রীচরণে শয়নরত, শঙ্খ, চক্র, গদা ও পদ্ম ধারণকারী এক মহাশক্তিধর দেবতা। বিষ্ণু ‘অনন্ত’ এবং ‘অচ্যুত’ নামেও পরিচিত। তিনি শত সহস্র নামে সম্বোধিত হন—যেমন নারায়ণ, হরি, মাধব, কেশব প্রভৃতি।


বিষ্ণুর দশ অবতার: ধর্ম রক্ষার মহামিশন

হিন্দু ধর্মে বিশ্বাস করা হয়, যখনই পৃথিবীতে অন্যায় ও অধর্মের পরিমাণ বেড়ে যায়, তখন ভগবান বিষ্ণু অবতার গ্রহণ করে দানব ও অন্যায়কে ধ্বংস করেন এবং ধর্ম প্রতিষ্ঠা করেন। এই দশ অবতারকে বলা হয় ‘দশাবতার’—

  1. মৎস্য অবতার – মহাপ্রলয়ের সময় জ্ঞানের রক্ষা করেন।

  2. কূর্ম অবতার – সমুদ্র মন্থনের সময় পর্বতকে ধারণ করেন।

  3. বরাহ অবতার – পৃথিবীকে পাতাল থেকে উদ্ধার করেন।

  4. নরসিংহ অবতার – অসুর হিরণ্যকশিপুকে বধ করেন।

  5. বামন অবতার – বলিকে তিন পা জমি দিয়ে সমস্ত সত্ত্ব দান করান।

  6. পরশুরাম – ক্ষত্রিয়দের দমন করেন অহংকারের জন্য।

  7. রাম – রাবণ বধ করে আদর্শ রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করেন।

  8. শ্রীকৃষ্ণ – কুরুক্ষেত্রে ধর্মপথে প্রতিষ্ঠা এবং গীতা উপদেশ প্রদান করেন।

  9. বুদ্ধ – অহিংসার বাণী প্রচার করেন।

  10. কল্কি – ভবিষ্যতে অবতার নেবেন কলিযুগের পাপ ধ্বংস করতে।


বিষ্ণুর শক্তির রূপ ও বিস্তার

বিষ্ণুর শক্তি কেবলমাত্র তাঁর অস্ত্র বা অবতারে সীমাবদ্ধ নয়, বরং তিনি সময়, স্থান ও চেতনার ঊর্ধ্বে অবস্থান করেন। তাঁর চক্র (সুদর্শন), গদা (কৌমোদকী), শঙ্খ (পাঞ্চজন্য) প্রতিটি অস্ত্রের পেছনে আছে এক গূঢ় আধ্যাত্মিক শক্তি। বিষ্ণুর অনন্ত শয়ন, তাঁর বাহন গরুড় এবং লক্ষ্মীর সহচরীতা সব কিছুই তাঁর ঐশ্বরিকতার প্রতীক।

তিনি ভক্তদের অন্তরেও বাস করেন, যেমন বলা হয়—“অন্তর্যামী নারায়ণ”। তাঁর কৃপায় ভক্তরা পাপমুক্ত হন ও মোক্ষলাভ করেন।


বিষ্ণু ও শ্রীমদ্ভাগবত

শ্রীমদ্ভাগবত পুরাণ হলো বিষ্ণুর মাহাত্ম্যের এক অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ। এখানে তাঁর অবতার, লীলা এবং ভক্তিরূপের মাধ্যমে ধর্ম প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছে। শ্রীকৃষ্ণরূপে তিনি গোপীদের সঙ্গে রসলীলা করেন, যেটি আধ্যাত্মিক প্রেম ও পরম ভক্তির প্রতীক।


বিষ্ণুভক্তি ও আধুনিক সমাজে প্রাসঙ্গিকতা

বর্তমান যুগে ভগবান বিষ্ণুর ভক্তি সমাজে আশার আলো এনে দেয়। ইসকন মন্দির ও অন্যান্য বিষ্ণু-ভক্তি সংগঠনগুলি সারা পৃথিবীতে ভগবানের নাম প্রচার করছে—“হরে কৃষ্ণ হরে রাম” মহামন্ত্রের মাধ্যমে মানুষ শান্তি ও মুক্তির সন্ধান পাচ্ছে।


উপসংহার

ভগবান বিষ্ণু শুধু একজন পৌরাণিক দেবতা নন, তিনি হিন্দু ধর্মে এক চিরন্তন শক্তির আধার। তাঁর দশাবতার আমাদের শিক্ষা দেয় ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়ানো, অহংকার ত্যাগ করা এবং পরম ভক্তির মাধ্যমে মোক্ষের পথ খোঁজা। হিন্দু পুরাণে বিষ্ণুর মাহাত্ম্য অনন্ত—তাঁর নাম স্মরণেই জন্ম পায় শান্তি ও শক্তির অনুভব।

“ওঁ নমো নারায়ণায়” উচ্চারণের মাধ্যমে ভগবান বিষ্ণুর কৃপা লাভের দ্বার উন্মুক্ত হয়। যাঁর হৃদয়ে বিষ্ণু বিরাজমান, তাঁর জীবনে কখনোই অন্ধকার দীর্ঘস্থায়ী হয় না।

Leave a Comment